অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানদের একটা কম্পিউটার বা মোবাইল দিলেই তারা লেখাপড়া শিখে ফেলবে। কিন্তু তারা জানে না যে, এসব ডিভাইস তাদের জন্য কী সমস্যা নিয়ে আসতে পারে। ইন্টারনেটে কী ব্যবহার করেন, এ বিষয়ে তাদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ইন্টারনেটের অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি এর অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। তাই এর ব্যবহার সম্পর্কে অভিভাবকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বেশির ভাগ অভিভাবক জানেন না, অনলাইনে তার সন্তান কার সঙ্গে মেশে, কী ধরনের তথ্য শেয়ার করে। অভিভাবকদের অসচেতনতায় শিশুরা খুব সহজে অনলাইনে বুলিং, যৌন হয়রানি ও অপরাধের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে তাদের তদারক করা প্রয়োজন, তারা সেটা হয়তো অনেকেই জানে না। এ থেকে রক্ষায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের জীবনযাত্রা বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি ভার্চুয়াল হয়ে উঠেছে। সেই স্রোতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সাইবার জগতের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন। প্রযুক্তিনির্ভর এখন প্রায় প্রতিটি পরিবার। কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শ্রেণি ও পেশার অনেক মানুষ ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, যোগাযোগ, অফিস, লেখাপড়াসহ দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ কাজ আমরা এখন অনলাইনেই করছি। মহামারি করোনা ভাইরাস আমাদের সাভাবিকের চেয়ে বেশি অনলাইননির্ভর করেছে। পরিবারের ছোট সদস্যরাও বাদ পড়ছে না সাইবার সেবা থেকে।
 
 অপরদিকে এই ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হলেও বিশ্বনাগরিক হিসেবে ব্যবহারকারীদের সিংহভাগই সচেতন নন। কিছু মানুষের অশুভ প্রয়াসে অনেকেই নানামুখী সমস্যায়ও পড়ছেন।
 
অনেকেই ‘অন্তর্জালে’ যুক্ত হতে গিয়ে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়ছেন ‘ভ্রান্তির-জালে’। এভাবেই অপরাধের ডিজিটাল রূপান্তরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
 
 তাই ইন্টারনেটনির্ভর ভার্চুয়াল জগতের যেমন রয়েছে বিশাল সেবার ভাণ্ডার পক্ষান্তরেই রয়েছে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিশাল সমাহার। তাই ভার্চুয়াল জগতে চলতে গেলে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রতিটি বিষয়ের ২টি দিক থাকে— একটি ইতিবাচক অপরটি নেতিবাচক। কে কোনটি গ্রহণ করছেন, তারা সাইবার দুনিয়ার কতটা ইতিবাচক দিকের সাথে মিশছেন তার ওপর নির্ভর করছে তার নেট দুনিয়ার জীবনযাপন।
 
 আমাদের পরিবারের ছোটরা সাইবার দুনিয়ার কতটা ইতিবাচক দিকের সাথে মিশছে সেটি দেখার দায়িত্ব রয়েছে পরিবারের বড়দের। কিন্তু কোনোকিছু দেখভাল করার আগে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন আছে। নব্বইয়ের দশকের পূর্বে কিংবা বিংশ শতাব্দি ও এর পরেও বেশকিছুদিন ইন্টারনেট সম্পর্কিত প্রযুক্তিগুলোর তেমন ব্যবহার ছিলো না। তাই সে সময় থেকে শুরু করে তার পূর্বের মনুষরাও এর সাথে তেমন পরিচিত নন। নব্বইয়ের দশকের পূর্বে জন্ম নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই এখন বিবাহ তৎপরবর্তী সন্তানের জনক-জননী হয়েছেন। তাদের পরিবারের ছোট সদস্যরা সাইবাার সেবা থেকেও পিছিয়ে থাকছে না। কিন্তু ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা থেকে এই অভিভাবকরা অনেকটা পিছিয়ে।
 
 মাটি, পানি, বায়ুর সংমিশ্রণে নির্মিত পৃথিবী যেমন একটি দুনিয়া, ইন্টারনেটনির্ভর বিশ্বও তেমনি একটি ভিন্ন দুনিয়া। একজন পিতা বা মাতার বাস্তব জীবনে সন্তানের নিরাপত্তা দেয়া যেমন দায়িত্ব, তোমনই সাইবার জগতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একটি অনন্য দায়িত্ব। এজন্য সাইবার বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
 
কথা বলি কয়েকজন টিনএজারের সাথে। তাদের সবার মতামতের পরিসংখ্যান এই দাঁড়ালো যে, অনেকের বাবা-মা সাইবার দুনিয়ার সাথে কিছুটা পরিচিত কিন্তু যুক্ত নন, কারো কারো বাবা-মা প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে ইন্টারনেটের সংগে পরিচিত ও ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা তেমন দক্ষ নন। এদের অনেকেই আবার সোস্যাল মিডিয়ায় সন্তানের ব্ল্যাকলিস্টে থাকেন। সন্তানের পাসওয়ার্ড সেট করা ফোনটিও খুলে দেখবার সুযোগ নেই এমন অনেক বাবা-মার। এর প্রেক্ষিতে জানতে পারেন না তার সন্তান কি করছে নেট দুনিয়ার বিশাল জগতে! এভাবেই গড়ে উঠতে পারে সাইবার দুনিয়ার বিশাল অপরাধের দেয়াল।
 
 
সেই কিশোরদের প্রশ্ন করা হলো— বাবা-মাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লক করে রেখেছ কেন?
 
তারাও দেখালো অনেক কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- বাবা-মা তাদের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকলে তাদের দেয়া পোস্টগুলো জেনে যাবেন, সবকিছুই বাবা-মার সামনে উপস্থাপন করা যায় না। প্রশ্ন রয়েই যায়, তাহলে কি বাবা-মা তাদের বন্ধু হতে পারেনি, নাকি বাবা-মাকে অড়াল করেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে অনন্দ খুঁজে পান তাদের সন্তানরা?
 
কিন্তু অপরাধীরা এই সুযোগগুলো কাজে লাগাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ।
 
শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দেয়ার পর সেখানে কার্টুন দেখার নামে কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট দেখানো হচ্ছে। শিশুদের কোমল মনকে নষ্ট করার উদ্দেশ্যে মাঠে সক্রিয় আছেন নোংরা মানসিকতার কিছু অপরাধী। সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, গ্যাং কালচার, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, আসক্তি— এর সবই হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাস্তব জীবনে ঘটমান অপরাধগুলো এখন ডিজিটাল মাধ্যমে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
 
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ)’। সেখানে তারা বলেছেন, বয়সভিত্তিক জরিপে সাইবার অপরাধে আক্রান্তের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এদের মধ্যে বেশির ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮-৩০ বছর। পরিসংখ্যানে ভুক্তভোগীদের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিশু। ১৮ বছরের কম বয়সি এই ভুক্তভোগীদের হার ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ। অপরাধের শিকার হয়েও প্রায় ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয় নেন না।
 
একজন অভিভাবক হিসেবে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। ১. শিশুরা যেন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। ২. শিশুরা যেন নিরাপত্তার সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। অভিভাবকরা জানেন, তাদের সন্তানরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানদের একটা কম্পিউটার বা মোবাইল দিলেই তারা লেখাপড়া শিখে ফেলবে। কিন্তু তারা জানে না যে, এসব ডিভাইস তাদের জন্য কী সমস্যা নিয়ে আসতে পারে।
 
ইন্টারনেটে কী ব্যবহার করেন, এ বিষয়ে তাদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ইন্টারনেটের অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি এর অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। তাই এর ব্যবহার সম্পর্কে অভিভাবকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বেশির ভাগ অভিভাবক জানেন না, অনলাইনে তার সন্তান কার সঙ্গে মেশে, কী ধরনের তথ্য শেয়ার করে। অভিভাবকদের অসচেতনতায় শিশুরা খুব সহজে অনলাইনে বুলিং, যৌন হয়রানি ও অপরাধের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে তাদের তদারক করা প্রয়োজন, তারা সেটা হয়তো অনেকেই জানে না। এ থেকে রক্ষায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তানরা যেন নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন, এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
 
লেখক : সাংবাদিক ও শিশু অধিকারকর্মী